শহীদ আবদুল্লাহ বিন জাহিদ



ছোট ছেলেটার ক্যান্সার ধরা পড়ছেও কাছে এসে বারবার জিজ্ঞেস করেভাইয়া কী আর আসবে নাআম্মুআমি তো অসুস্থতোমাকে কার কাছে রেখে যাব!

 

৫আগষ্ট সকালে আবদুল্লাহ মাকে বলেআম্মু আমি একটু সামনে থেকে হেঁটে আসি। বাইরে খবর জেনে চলে আসব।

 

মা বলেযাও। আন্দোলনে যেও নাবাবা।

 

মায়ের কথায় সায় দিয়ে আবদুল্লাহ বাসা থেকে বের হয়। তখন আনুমানিক এগারোটা। ঘন্টা দুয়েক বাইরে ঘুরাফেরা করে বাসায় ফিরে আসে।

 

বাসায় এসে মাকে বলেআম্মু আমাদের বাসায় তো ডিশ নাইইন্টারনেটও বন্ধ। চল আমরা নানুর বাসায় চলে যাই। ঐখানে খবর দেখতে পারব কী হচ্ছে না হচ্ছে। (নানুর বাসা তাদের বাসার কাছাকাছিই। আস্কানাএয়ারপোর্ট রোডে।)

 

আম্মু বলেঠিক আছে আমরা ঐখানেই চলে যাই৷ রেডি হয়। এরমধ্যে মায়ের সাথে খুনসুটিও হয় ড্রেস পরা নিয়ে। নানুর বাড়িতে শার্ট পরে যাবে নাটি-শার্ট পরে যাবে৷ দুপুর ২টার দিকে তারা চলে যান এয়ারপোর্ট রোডে আস্কানা মায়ের (আবদুল্লাহর নানুর বাসা) বাসায়। ঐখানে যাওয়ার পর বড় মামা তাকে গলির দোকান থেকে আলু কিনতে পাঠায়। আলু কেনা শেষে ৩৫টাকা বেছে যায়। বাসায় এসে আবদুল্লাহ বাকি টাকাটা মাকে ফেরত দেয়মামাকে দিও। মা তাকে বলেএটা তোমার কাছে রেখে দাও। আমি তোমার মামাকে বলবতুমি চিপস খাবে বাকি টাকাটা দিয়ে।

 

এরমধ্যে টিভিতে ইতিবাচক খবর আসে। সেনাপ্রধান বক্তব্য দেবেন জাতির উদ্দেশ্য। আবদুল্লাহ বুঝে গিয়েছে ছাত্র-জনতার কাঙ্খিত বিজয় অতি সন্নিকটে। হয়ত কিছুক্ষণের ভেতর রাস্তায় মানুষের জনস্রোত নামবে। সে ইতিহাসে নিজেকেও সাক্ষী রাখবে। ও মাকে বলেআম্মু আমি বিজয় মিছিল থেকে ঘুরে আসি। এখন আর কোনো সমস্যা হবে না

 

মা তাকে এবার মিছিলে যেতে আর বাঁধা দেয় না। এ সময় এসে কোনো মায়ের আর উদ্বিগ্ন হওয়ার কথাও নয়। দুপুরে নানুর বাসায় ইলিশ রান্না করা হয়েছে। আবদুল্লাহ বের হওয়ার আগে আবদার করে মায়ের হাতেই ভাত খেয়ে বের হবে৷ মা-ও তাকে নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দেয়। যাওয়ার আগে আম্মু তাকে বলে দেনসন্ধ্যার আগেই ফিরে আইসোবাবা। বাসা থেকে বের হতে হতে আবদুল্লাহ জবাব দেয়ঠিক আছে আম্মু।

 

বাসার ভেতর বসে টিভিতে আপডেট খবর দেখতে থাকেন মা। এদিকে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে ছেলে ফিরছে না কেন। কিছুটা দুশ্চিন্তা নিয়ে সন্ধ্যা ৭টা ১২ মিনিটে ছেলেকে কল দেয়কিন্তু রিসিভ হয় না। পরে আবার ৭টা ৩৪মিনিট কল দেন। এবার রিসিভ হয়। ছেলে রিসিভ করতেই এপাশ থেকে মা সালাম দিয়ে বলেবাবাসন্ধ্যা হয়ে গেছে না! আবদুল্লাহ জবাব দেয়আম্মু আধা ঘণ্টার ভেতর চলে আসব। এটাই ছেলের সাথে শেষ বারের মতো কথা। মা-ছেলের শেষবার কনভারসেশনে এই ফোনকলের দৈর্ঘ্য ছিল ১৭সেকেন্ড

 

এর ঠিক আধা ঘণ্টা পর ৮টা ১০ মিনিটের দিকে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই বলেউত্তরা উইমেন মেডিকেল থেকে বলছেতার ছেলে ইঞ্জুরড হয়েছে। গুলিবিদ্ধ।

 

আধা ঘণ্টা আগে যে ছেলে স্বাভাবিকভাবে কথা বলেছে। ঘরে ফিরে আসছে বলেছেসে ছেলের এমন দুঃসংবাদ শুনে হতভম্ব হয়ে দৌঁড়িয়ে মেডিকেলে যান। মা হাসপাতালে গিয়ে পৌঁছানোর আগেই ছেলে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। শহীদের তালিকায় যোগ হয়ে যায় আরও একটি নাম

 

এর আগে নাকি আবদুল্লাহ ডাক্তারদের বলতেছিল,‘ আমি ত বাঁচব নাআমার আম্মুকে কল দেন। আম্মু আসলে আমি ঠিক হয়ে যাব।’ ডাক্তারকে মায়ের নম্বর ও-ই দিয়েছিল। যে ছেলেটি রাস্তা থেকে গুলিবিদ্ধ আবদুল্লাহকে হাসপাতালে নিয়ে আসে সে হাসপাতালে সেন্সলেস হয়ে যায়৷ এতোটা ভয়াবহ ছিল তার পরিস্থিতি।

 

আবদুল্লাহর শরীরে দুইটা গুলি লাগে। একটা গলায়আরেকটা পিঠে। গলার গুলিটা কোনাকুনিভাবে ঝাঁঝরা করে ফেলে তার গলা। এতটা গভীরে গিয়ে ক্ষত সৃষ্টি করছে যেরক্তে তার সারা মুখ ভেসে যায়। গায়ের সাদা টি-শার্ট রক্তে লাল হয়ে যায়। পিঠের গুলিটা কেউ লক্ষ করে নাই। দাফনের আগে গোসল করাতে গিয়ে নজরে পড়ে।


রাতেই আবদুল্লাহ নিয়ে যাওয়া হয় গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ বর্শিকুড়ায়। সেখানে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়

 

ওর পুরো নাম আবদুল্লাহ বিন জাহিদ। শহীদ রমিজ উদ্দিন কলেজের ব্যবসা শিক্ষা বিভাগে উচ্চমাধ্যমিক ২য় বর্ষের ছাত্র ছিল। সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ছিল প্রিয়পাত্র। সবার সাথে ছিল সুসম্পর্ক। বয়স মাত্র ১৭ বছর। সামনে ১ নভেম্বর তার জন্মদিন। বিজয় মিছিল থেকে সবাই আনন্দ উল্লাসে ঘরে ফিরলেওফিরেনি আবদুল্লাহ। মা গিয়ে হাসপাতাল থেকে আনতে হলো ছেলের লাশ। সামনে ছেলের জন্মদিনের কথা বলতে গিয়ে মা কান্নায় আর কথা বলতে পারছেন না। এই ১ নভেম্বর কী কোনভাবে কেলেন্ডার থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়?

 

একদিকে কলিজার টুকরা বড় ছেলেকে হারানোর ক্ষত না সয়ে উঠতে আরেকদিকে ছোট ছেলের ক্যান্সার ধরা পড়ে। মেডিকেল থেকে বাসা ছেলেকে নিয়ে একাই দৌঁড়াদৌঁড়ি করতে করতে পাগলপ্রায় এই মা।

 

বড় ভাইয়ের জন্য কাঁদতে কাঁদতে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছে ছোট ছেলে। বাববার মাকে জিজ্ঞেস করেভাইয়া কী আর ফিরবে নাআম্মুআমি তো অসুস্থতোমাকে কে দেখে রাখবে!


লেখা: ফরিদ উদ্দীন রনি 

 

Post a Comment

0 Comments